রপ্তানি করা গার্মেন্টস পন্য চুরির অভিযোগে কভার্ডভ্যান সহ ৪ জন কে আটক করেছে র‍্যাব-৪

রাকিবুল ইসলাম সোহাগঃ-কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ থানা এলাকা হতে প্রায় ৪ কোটি টাকা মূল্যের রপ্তানিযোগ্য চোরাই গার্মেন্টস মালামালসহ সংঘবদ্ধ আন্তঃ জেলা চোরচক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৪; বিপুল পরিমাণ কিটস পোশাক সামগ্রী, ১টি কাভার্ড ভ্যান জব্দ।


গত ১৪ আগস্ট ২০২১ ঢাকা জেলার আশুলিয়া ও গাজীপুর থেকে গার্মেন্টস মালামাল বিভিন্ন দেশে রপ্তানী করার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের নেওয়ার পথে কিছু কিছু কাভার্ড ভ্যান হতে প্রায় ৩০%-৪০% দামী গার্মেন্টস মালামাল উধাও হবার ছায়া তদন্তের এক পর্যায়ে ফ্যাক্টরী থেকে মালামাল নেওয়ার সময় পথিমধ্যে নারায়নগঞ্জ জেলার বন্দর থানার একটি পরিত্যাক্ত রি-রোলিং মিলস্ এ কাভার্ড ভ্যান থামিয়ে র‌্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল আন্তঃজেলা চোর চক্রের মূলহোতা মোঃ সিরাজুলসহ ০৬ জনকে আনুমানিক ০৬ কোটি টাকা মূল্যের চোরাইকৃত ৪১ বস্তা ও ৫০৬ কার্টুন ভর্তি গার্মেন্টস সামগ্রীসহ কাভার্ড ভ্যান জব্দ ও গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়। কিন্তু পরবর্তীতে মূলহোতা সিরাজুল গত তিন মাস পূর্বে হাজত থেকে জামিনে বের হয়ে আবারও পূর্বের ন্যায় একই কার্যক্রম শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ রাতে র‌্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিন থানাধীন বেলতলী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে আনুমানিক ০৪ কোটি টাকা মূল্যের চোরাইকৃত প্রায় ৪৫৭ কার্টুন ভর্তি গার্মেন্টস সামগ্রী একটি কাভার্ড ভ্যানসহ সংঘবদ্ধ আন্তঃজেলা চোরচক্রের ০৪ সদস্য’কে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় এবং ঘটনাস্থল হতে চালকসহ ৩/৪ জন আসামী পালিয়ে যায়। ইতোমধ্যে উদ্ধারকৃত গার্মেন্টস মালামালসমূহ সংশ্লিষ্ট পোশাক প্রস্তুতকারী সংস্থার কর্তৃপক্ষ তাদের বলে সনাক্ত করেছে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা হলোঃ


(ক) মোঃ হিমেল @ দুলাল (৩৮), জেলা-ভোলা।

(খ)  আবুল কালাম (৪০), জেলা-ভোলা।

(গ)  মোঃ মহসিন আলী @ বাবু (৩১), জেলা- কুমিল্লা।

(ঘ)  মোঃ আলামিন (৩০), জেলা-বগুড়া।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত আসামীরা পরস্পর যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা, আশুলিয়া ও গাজীপুর থেকে বিভিন্ন দেশে রপ্তানীর গার্মেন্টস মালামাল চুরির ঘটনার সাথে জড়িত মর্মে স্বীকারোক্তি প্রদান করে। জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায় যে, তারা মালামাল পরিবহনে নিয়োজিত চালকদের সাথে সংঘবদ্ধ হয়ে একটি দুর্র্ধষ চোরাকারবারী চক্র গঠন করে পরস্পর যোগসাজোশে বিগত কয়েক বছর ধরে গার্মেন্টস মালামাল কাভার্ড ভ্যান হতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় চুরি করে স্থানীয় মার্কেটে চোরাইপথে কমদামে বিক্রি করে আসছিলো। এতে করে দেশ প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি গার্মেন্টস মালিকগণ প্রতিনিয়ত বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে আসছিলেন। প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এ ধরনের কয়েকটি চক্র ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সক্রিয় রয়েছে এবং প্রতি বছর শত কোটি টাকা মূল্যের বেশী পোশাক এসব চক্রের মাধ্যমে চুরি হয়ে যাচ্ছে।

চুরির কৌশলঃ এই চোরচক্রটি সাধারণত কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভারের সাথে সখ্যতা তৈরির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার লোভ দেখানো ও চুরির মালামাল বিক্রয়ের টাকার অংশ দেওয়ার কথা বলে ড্রাইভারকে রাজি করিয়ে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর এলাকা হতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নিকটবর্তী নির্জন এলাকার ভিতর কাভার্ড ভ্যান পার্কিং করাতো। পরবর্তীতে পলাতক মূলহোতা মোঃ সিরাজুল এর নির্দেশে গ্রেফতারকৃত আসামী হিমেল, আবুল কালাম, মহসিন ও আলামিন এবং পলাতক সহযোগী নুর জামানসহ অন্যন্য অজ্ঞাতনামা সহযোগীরা মিলে বিশেষ কৌশলে কাভার্ড ভ্যানের সিলগালা তালা না খুলে কাভার্ড ভ্যানের পাশের ওয়ালের নাট-বল্টু খুলে প্রত্যেক কার্টুন ভিতরে থাকা মালামালের ৩০%-৪০% মালামাল নিয়ে পূর্বের ন্যায় কার্টুন সঠিকভাবে বাধাই করে তাদের কাভার্ড ভ্যানে নিয়ে যেতো যাতে করে ফ্যাক্টরী মালিক ও বন্দর কর্তৃপক্ষ কেউই সন্দেহ না করতে পারে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এই চোরচক্রটি কার্টুনের মালামালের ওয়েট ঠিক রাখার জন্য যে পরিমানের মালামাল কার্টুন থেকে চুরি করে সরিয়ে রাখে ঠিক সে পরিমান ঝুট কার্টুনের ভিতর মালামালের মাঝখানে দিয়ে কার্টুন প্যাকেট করে। যার ফলে বন্দরে স্ক্যানিং কিংবা ওয়েট মেশিনে কোন ধরণের অনিয়ম পরিলক্ষিত হয় না। এছাড়াও মালামালসহ সম্পূর্ণ ট্রাক/কাভার্ড ভ্যানও মাঝে মাঝে তারা লুট করেছে বলে স্বীকারোক্তি প্রদান করেছে।

 চোরাইকৃত মালামালের ডিসপোজাল প্রক্রিয়াঃ দলের এই সদস্যরা নিম্নোক্ত তিন প্রক্রিয়ায় চোরাইকৃত গার্মেন্টস মালামাল ডিসপোজাল করতোঃ

প্রথমতঃ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী থেকে মালামাল কাভার্ড ভ্যানে সিলগালা অবস্থায় সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে না নিয়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে সুবিধাজনক সময়ে নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর, কুমিল্লা বা নিকটবর্তী নির্জন এলাকা বা পরিত্যক্ত ভবনের ভিতর কাভার্ড ভ্যান পার্কিং করে।

  দ্বিতীয়তঃ এই চক্রের সদস্য যে নাট-বল্টু খোলায় পারদর্শী সে বিশেষ কৌশলে কাভার্ড ভ্যানের সিলগালা তালা না খুলে সরাসরি কাভার্ড ভ্যানের সাইডের ওয়ালের নাট-বল্টু খুলে ফেলত এবং তার অন্যান্য সহযোগীরা খুব দ্রæততম সময়ের মধ্যে প্রতিটি কার্টুন খুলে ৩০%-৪০% মালামাল সরিয়ে কার্টুনের ভিতরে সমপরিমান ঝুট রেখে আবার পূর্বের ন্যায় কার্টুন প্যাকেট করত যাতে কোন সন্দেহের আবকাশ না থাকে এবং বন্দরে কোন ধরণের অনিয়ম ধরা না পড়ে।

  তৃতীয়তঃ স্থানীয় বাজারে বাংলাদেশি গার্মেন্টস মালামালের চাহিদা ব্যাপক থাকায় এবং মালামালের গুণগত মান উন্নত হওয়ায় মূলহোতা পলাতক আসামী সিরাজুল ও তার সহযোগী নুর জামান এবং গ্রেফতারকৃত আসামী হিমেল খুব দ্রæততম সময়ে তা বিক্রি করে বিক্রিত অর্থ প্রত্যেকের কাছে ভাগাভাগি করে পৌছে দিতো।

গার্মেন্টস মালামাল চুরি যাওয়ার এর ফলে গার্মেন্টস সেক্টর ও দেশের ক্ষতিঃ এই সংঘবদ্ধ চোর চক্রটি গার্মেন্টস মালামাল চুরি করার ফলে গার্মেন্টস সেক্টর ও দেশের নিম্নোক্ত ক্ষতি হয়ে আসছেঃ

 গার্মেন্টস সেক্টরঃ যেহেতু মালামাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে বন্দর পর্যন্ত পৌছে দেওয়া ফ্যাক্টরী মালিকের দায়িত্ব, তাই মালামাল চুরি যাওয়ার কারণে ফ্যাক্টরি মালিকদের পুনরায় মালামাল চট্টগ্রাম বন্দরে প্রেরণ করায় সময় ও অর্থের প্রচুর ক্ষতিসাধন হয়। বিদেশী ক্রেতা সঠিকভাবে ও সঠিকসময়ে মালামাল ডেলিভারি না পাওয়ার কারণে মালামালে মূল্য পরিশোধ করতোনা এবং পরবর্তীতে উক্ত ক্রেতারা ক্রয় আদেশ দিতোনা। ফলে দিন দিন দেশের গার্মেন্টস সেক্টর প্রচুর লোকসানের সম্মুখীন হয়ে আসছিলো। সঠিকসময়ে বিদেশী ক্রেতাদের নিকট নির্ধারিত গার্মেন্টস পণ্যটি পৌছে না দেওয়ার ফলে বিদেশী ক্রেতাদের কাছ থেকে বাংলাদেশি গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনের ঘাটতি দেখা যায় এবং দিন দিন বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্পের ঐতিহ্য ও সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে।

 দেশের সামগ্রিক লোকসানঃ  গার্মেন্টস সেক্টরের মাধ্যমে দেশের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে এবং সেই সাথে উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম অর্জিত হয়। কিন্তু উক্ত মালামাল চোরাই পথে বিক্রির কারণে বিপুল পরিমান রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার সাথে সাথে বহিঃবির্শ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও সুনাম নষ্ট হচ্ছিলো। এভাবে চুরির ফলে বিদেশী ক্রেতারা তাদের প্রাপ্য মালামালের চেয়ে কম মালামাল পাওয়ায় বাংলাদেশী পোশাক প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতাদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে এবং এই চুরি রোধ করা সম্ভব না হলে বিদেশী ক্রেতাদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনাও তৈরী হচ্ছিল। ফলে বাংলাদেশের ক্রয় আদেশ অন্য পোশাক প্রস্তুতকারী দেশে চলে যাওয়ার আশংকা তৈরী হয়েছিলো এবং বাংলাদেশী পোশাক প্রস্তুতকারী কারখানাসমূহ আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল। এছাড়াও র‌্যাব ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে এই আন্তঃজেলা চোরচক্রটির অনেক সদস্যকে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার করে আইনের কাছে সোপর্দ করে গার্মেন্টস শিল্পকে একটি নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টির প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। 

 গ্রেফতারকৃত আসামী মোঃ হিমেল @ দুলাল (৩৮) ভোলা জেলার সদর থানাধীন পূর্ব ইলিশা গ্রামে এক জেলে পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। সে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করতে না পেরে জীবিকার তাগিদে ২০১০ সালের দিকে ঢাকায় আসেন। শুরুতে সে কনস্ট্রাকশন কাজের রড মিস্ত্রী হিসেবে কাজ করে। পরবর্তীতে পেশা পরিবর্তন করে কিছুদিন লেগুনার হেলপার এবং ড্রাইভিং শিখে ড্রাইভার হিসেবে কাজ করে। পরবর্তীতে ড্রাইভার হিসেবে বাস ও প্রাইভেটকার চালায়। ২০২০ সালের শুরুতে এই চোরচক্রের মূলহোতা পলাতক আসামী সিরাজুল এর সাথে পরিচয় হয়। পরিচয়ের সুবাদে আসামী দুলাল সিরাজুলের প্রাইভেটকারের চালক হিসেবে কাজ করে। একপর্যায়ে আসামী হিমেল @ দুলাল পলাতক আসামী সিরাজুলের সাথে মিলে এই চোরচক্রের একজন অন্যতম সদস্য হয়ে নিজে এই চোরচক্রটিকে সিরাজুলের নির্দেশক্রমে পরিচালনা করে আসত। ব্যক্তিগত জীবনে সে বিবাহিত এবং ০২ ছেলে সন্তানের জনক। গোয়েন্দা অনুসন্ধানে জানা যায় যে, এই চুরির মাধ্যমে সে একটি কাভার্ড ভ্যান ক্রয় করেছে এবং এছাড়াও ঢাকা ও ভোলাতে তার একাধিক বাড়ি ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। পলাতক আসামী সিরাজের ঢাকাতে একাধিক বাড়ি ও গাড়ি রয়েছে। 

 গ্রেফতারকৃত আসামী আবু কালাম (৪০) পেশায় একজন দক্ষ মিস্ত্রি। সে মূলত কাভার্ড ভ্যানের সিলগালা তালা না খুলে কাভার্ড ভ্যানের পাশের ওয়ালের নাট-বল্টু খুলতে পারদর্শী। সে এই কাজের বিনিময়ে প্রত্যেক চুরিতে প্রায় লক্ষাধিক টাকা পেত।  গ্রেফতারকৃত আসামী মহসীন আলী @ বাবু (৩১) কুমিল্লায় গোডাউনের মালিক যেখানে চোরাইকৃত মালামাল লোড-আনলোড করে রাখা হত। মূলত তার ছত্রছায়ায় কুমিল্লাতে কাভার্ড ভ্যান লোড-আনলোড এবং চোরাইকৃত মালামাল রাখা হত। অপর গ্রেফতারকৃত আসামী আলামিন (৩০) একজন গার্মেন্টস পণ্য লোডিং-আনলোডিং শ্রমিক।

 উপরোক্ত বিষয়ে আইনানুগ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এরূপ সংঘবদ্ধ চোরাকারবারী দলের বিরুদ্ধে র‌্যাব-৪ এর জোরালো অভিযান অব্যাহত থাকবে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আশুলিয়ার চেতনা মাল্টিপারপাসের ১০ ভয়ংকর প্রতারককে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব-৪

কক্সবাজারের ঝিলংজা থেকে দশহাজার পিস ইয়াবা সহ মাদক কারবারি কে আটক করেছে র‍্যাব-১৫

কেরানীগঞ্জ থেকে পুলিশের এএসপি পরিচয়দানকারি প্রতারককে আটক করেছে র‍্যাব-১০