উত্তরায় মার্মন্তিক গার্ডার দুর্ঘটনার ঘটনায় ১০ জন কে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব

রাকিবুল ইসলাম সোহাগ:- মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক রাজধানীর উত্তরায় প্রাইভেটকারের উপর নির্মাণাধীন বিআরটি প্রকল্পের ক্রেন থেকে গার্ডার ছিটকে পড়ে একই পরিবারের ০৫ সদস্য নিহতের ঘটনায় ঘাতক ক্রেন চালক ও সহকারী এবং নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মীসহ ১০ জনকে ঢাকা, গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ ও বাগেরহাট থেকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব।


গত ১৫ আগস্ট ২০২২ তারিখে রাজধানীর উত্তরার জসীমউদ্দিন রোডে বিকাল আনুমানিক সোয়া চারটায় নির্মাণাধীন বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের ক্রেন থেকে গার্ডার ছিটকে প্রাইভেটকারের উপরে পড়ে। উক্ত মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই একই পরিবারের ০৫ জনের মৃত্যু হয় এবং ০২ জন গুরুতরভাবে আহত হয়। দুর্ঘটনার পরবর্তীত দ্রুততম সময়ে র‌্যাব সদর দপ্তরের Rapid Response Team ও র‌্যাব-১ এর একটি দল সর্বপ্রথম উদ্ধার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীতে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে ০৪ ঘন্টাব্যাপী উদ্ধার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। এসময় র‌্যাবের সহায়তায় অন্য একজন ক্রেন অপারেটর নিয়ে এসে গার্ডার উচু করে দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ি এবং নিহতদের উদ্ধারে সহায়তা করা হয়। উক্ত দুর্ঘটনায় ভিকটিম পরিবারের পক্ষ হতে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় অবহেলাজনিত কর্মকান্ড দ্বারা মৃত্যু ও গুরুতর জখমের সংঘটনের অপরাধে ০১টি মামলা দায়ের করা হয়; যার মামলা নং ৪১, তারিখ ১৬ আগস্ট ২০২২ ইং। একই পরিবারের ০৫ জনের মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক মৃত্যুর ঘটনা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে র‌্যাব জড়িতদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে । 

এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র‌্যাব-১,৩,৪,৬ এবং র‌্যাব-১২ এর যৌথ অভিযানে ক্রেন চালক (১) মোঃ আল আমিন হোসেন@ হৃদয় (২৫), পিতাঃ মোঃ আক্তার হোসেন, লৌহজং, মুন্সিগঞ্জ, হেলপার (২) রাকিব হোসেন (২৩), পিতাঃ মৃত আবুল বাশার, কবিরহাট, নোয়াখালী, দুর্ঘটনাস্থলে নিরপাত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিক ম্যান (৩) মোঃ রুবেল (২৮), পিতাঃ আবুল কাশেম, রায়পুর, লক্ষীপুর, (৪) মোঃ আফরোজ মিয়া (৫০), পিতাঃ মৃত সফর আলী, বানিয়াচং, হবিগঞ্জ, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার (৫) মোঃ জুলফিকার আলী শাহ (৩৯), পিতাঃ মোঃ আবু বকর সিদ্দিক, নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, হেভি ইকুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত ইফসকন বাংলাদেশ লিমিটেড এর সত্ত্বাধিকারী (৬) মোঃ ইফতেখার হোসেন (৩৯), পিতাঃ মৃত আব্দুস সাত্তার, যাত্রাবাড়ি, ঢাকা, হেড অব অপারেশন (৭) মোঃ আজহারুল ইসলাম মিঠু (৪৫), পিতাঃ মৃত আনোয়ার হোসেন পাটোয়ারী, মানিকদী, ঢাকা, ক্রেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানীর মার্কেটিং ম্যানেজার (৮) তোফাজ্জল হোসেন@ তুষার (৪২), পিতাঃ মোঃ জালাল উদ্দিন, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা (৯) রুহুল আমিন মৃধা (৩৩), পিতাঃ আমিনুল হক, ধামরাই, ঢাকা, (১০) মোঃ মঞ্জুরুল ইসলাম (২৯), পিতাঃ সিরাজুল ইসলাম, সদর, লক্ষীপুরদেরকে রাজধানীর জুরাইন, যাত্রাবাড়ী, কালসী, সাভার এবং গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ ও বাগেরহাট এর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে। 

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, গত ১৫ আগস্ট ২০২২ তারিখ বিআরটি প্রকল্পের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না গেজুবা গ্রুপ কোম্পানী (সিজিজিসি) এর তত্ত্বাবধানে ক্রেন দিয়ে প্রজেক্টের গার্ডার উত্তোলনের কাজ চলাকালীন উক্ত দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। দুর্ঘটনায় ঘাতক ক্রেনের চালক/অপারেটর মোঃ আল আমিন ও হেলপার রাকিব হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি হতে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের ওয়ার্ক অর্ডার পায় ইফসকন নামক একটি প্রতিষ্ঠান যার সত্ত্বাধিকারী গ্রেফতারকৃত মোঃ ইফতেখার হোসেন ও হেড অব অপারেশন গ্রেফতারকৃত মোঃ আজহারুল ইসলাম মিঠু। ভারী যন্ত্রপাতি ইফসকনের নিকট বড় ক্রেন না থাকায় তারা থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানীর নিকট হতে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ক্রেনটি ভাড়া নেয়। এছাড়াও প্রকল্প এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চয়নের দায়িত্বে থাকা ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিক ম্যান আফরোজ ও রুবেল এবং ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি এর সেফটি ইঞ্জিনিয়ার জুলফিকার আলীকে প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের এবং হেভি ইকুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা সিজিজিসি’র প্রকিউরমেন্ট অফিসার মঞ্জুরুল ইসলামকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে গ্রেফতার করা হয়।  

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, ঘাতক ক্রেনের মূল অপারেটর মোঃ আল আমিন। তার হালকা গাড়ী চালানোর অনুমোদন থাকলেও ভারী গাড়ী চালানোর লাইসেন্স নেই। ২০১৬ সালে ক্রেন চালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ২-৩টি নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করার পর ২০২২ সালের মে মাসে বিআরটি প্রকল্পে ক্রেন অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করে। গ্রেফতারকৃত রাকিব ০৩ মাস পূর্বে উক্ত প্রকল্পের ক্রেন হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করে। তার ক্রেন চালনা করার কোন ধরণের প্রশিক্ষণ ছিল না। দুর্ঘটনার দিনে আল আমিন ও রাকিব দুপুর ০২:০০ ঘটিকা হতে ক্রেন চালনা শুরু করে। একটি গার্ডার স্থাপন শেষে ২য় গার্ডার স্থাপনের সময় ক্রেনের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত ওজনের গার্ডার উত্তোলনের জন্য ক্রেনটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গার্ডারটি প্রাইভেটকারের উপর ছিটকে পড়ে উক্ত দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। আরও জানা যায় যে, দুর্ঘটনার সময় হেলপার রাকিব ক্রেন চালনা করছিল এবং ক্রেন অপারেটর আল আমিন ক্রেনের বাহির থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিল। দুর্ঘটনার পর অপারেটর আল আমিন হেলপার রাকিব ঘটনাস্থল হতে পলায়ন করে।  

 জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, ইফসকন কোম্পানী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি হতে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য ওয়ার্ক পারমিট প্রাপ্ত হয়। গার্ডার বহনের ক্রেন উক্ত প্রতিষ্ঠানের নিকট না থাকায় বিল্ড ট্রেডার্স নামক প্রতিষ্ঠান হতে অপারেটর ও হেলপারসহ উক্ত ক্রেনটি মাসিক চুক্তিতে ভাড়া নেয়। ইফসকন এর সত্ত্বাধিকারী গ্রেফতারকৃত ইফতেখার ও হেড অব অপারেশন গ্রেফতারকৃত মিঠু অপারেটরদের দক্ষতা ও যোগ্যতা ও ক্রেনের ফিটনেস যাচাই না করেই গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল সড়কে ভারী গার্ডার স্থাপনের কাজে নিয়োজিত করছিলেন। এছাড়াও গার্ডার স্থাপনের সময় অতিরিক্ত একটি সহায়ক ক্রেন উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তা ছিল না।

জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায় যে, থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার লিঃ মাসিক ভাড়ার চুক্তিতে উক্ত ক্রেন সরবরাহ করে। উক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা গ্রেফতারকৃত রুহুল আমিন এবং মার্কেটিং ম্যানেজার গ্রেফতারকৃত তুষার ক্রেনের ভাড়া প্রদান, চুক্তি, ড্রাইভার নিয়োগ; ক্রেনসমূহের ফিটনেস যাচাইসহ অন্যান্য দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। গ্রেফতারকৃত রুহুল ২০১০ সালে এবং গ্রেফতারকৃত তুষার ২০১৫ সালে উক্ত প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে। তারা অতিরিক্ত লাভের জন্য অল্প পারিশ্রমিকে ভারী গাড়ি চালনার লাইসেন্স ব্যতিত অপারেটর আল আমিনকে নিয়োগ প্রদান করে। এছাড়াও উক্ত ক্রেনের সর্বশেষ ফিটনেস যাচাই করা হয়েছিল সর্বশেষ ২০২১ সালে। কিন্তু ২০২২ সালে ক্রেনের কোন ধরণের ফিটনেস যাচাই করা হয়নি বলে জানা যায়। গ্রেফতারকৃত জুলফিকার সিজিজিসি এর বিআরটি প্রকল্পের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ২০২১ সালে যোগদান করে। সে মূলত এসএসসি পাশ। তাকে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার কোন ধরণের বর্ণিত ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ক দক্ষতা নেই। সে প্রকল্পের বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকা হতে উত্তরার আজমপুর এলাকা পর্যন্ত নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। দুর্ঘটনার দিনে ভারী গার্ডার স্থাপনের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সে কোন ধরণের নিরাপত্তা বেষ্টনী স্থাপন, পর্যাপ্ত ট্রাফিক নিয়োগ প্রদান করেনি। এছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হওয়া সত্ত্বেও সে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য ডিএমপি ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা ব্যতিরেইে উক্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। গ্রেফতারকৃত মঞ্জুরুল সাড়ে ৩ বছর যাবত এই প্রতিষ্ঠানে প্রকিউরমেন্ট অফিসার হিসেবে কাজ করে আসছে। সে চাইনিজ ভাষায় দক্ষ হওয়ায় উক্ত কোম্পানির সাথে যোগাযোগ স্থাপন ঠিকাদারী কাজ পাওয়ার ব্যবস্থা করে। 

গ্রেফতারকৃত রুবেল ০৩ মাস পূর্বে এবং গ্রেফতারকৃত আফরোজ গত মাসে ফোর ব্রাদার্স গার্ডস সার্ভিস ট্রাফিক ম্যান হিসেবে যোগদান করে। তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা বিষয়ক তাদের কোন প্রশিক্ষণ ছিল না। দুর্ঘটনার সময় তারা দুর্ঘটনাস্থলে প্রকল্পের ট্রাফিকম্যান হিসেবে নিয়োজিত ছিল।

গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আশুলিয়ার চেতনা মাল্টিপারপাসের ১০ ভয়ংকর প্রতারককে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব-৪

কক্সবাজারের ঝিলংজা থেকে দশহাজার পিস ইয়াবা সহ মাদক কারবারি কে আটক করেছে র‍্যাব-১৫

কেরানীগঞ্জ থেকে পুলিশের এএসপি পরিচয়দানকারি প্রতারককে আটক করেছে র‍্যাব-১০