রাজধানী থেকে র‍্যাব-৪ এর অভিযানে ক্ষুদ্র ঋণদান সমিতির সভাপতি সহ ২ সহযোগী প্রতারককে গ্রেফতার

 রাকিবুল ইসলাম সোহাগ :-রাজধানীর শাহ আলী এলাকা হতে প্রতারণার অভিযোগে কথিত ক্ষুদ্র ঋণদান সমিতির সভাপতি ফয়েজউল্লাহ ও তার ০২ সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৪; প্রতারণার বিপুল পরিমাণ মালামাল জব্দ।

              গ্রেফতারকৃত আসামি দয় 

সাম্প্রতিককালে প্রতারণার নতুন নতুন কৌশল ব্যবহার করে সাধারণ জনগণকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এক শ্রেণীর পেশাদার প্রতারক চক্র। অতি সম্প্রতি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম), ই-কমার্স, সমবায় সমিতি, এনজিও, অনলাইন ব্যবসার মাধ্যমে অসংখ্য মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে সর্বশান্ত করার বেশকিছু অভিযোগ পেয়েছে র‌্যাব। এই সকল প্রতারকদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ফাল্গুনী ডটকম ও “কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ” এর মতো বেশকিছু সফল অভিযান পরিচালনা করেছে র‌্যাব-৪।

প্রেস বৃফিং করছেন র‍্যাব-৪ অধিনায়ক মোয়াজ্জেম 

সম্প্রতি মিরপুর এলাকার কতিপয় ক্ষতিগ্রস্থ ভুক্তভোগীদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখ ২০.৩০ ঘটিকা হতে ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখ ০৮.৩০ ঘটিকা পর্যন্ত র‌্যাব-৪ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল মহানগরীর শাহ আলী থানাধীন মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্স এ অভিযান পরিচালনা করে প্রতারণা দায়ে “শিবপুর ক্ষুদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড” এর সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ (৫০) সহ মোট ০৩ জনকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়। উল্লেখ্য যে, উক্ত প্রতিষ্ঠানটি শিবপুর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতি লিমিটেড হিসেবে রেজিস্টার্ডভুক্ত হলেও প্রতারণামূলকভাবে “শিবপুর ক্ষুদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড” নামে প্রচার ও বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলো। উক্ত ভুয়া সমিতির ২০ জন সদস্য অন্তর্ভুক্তির কথা উল্লেখ থাকলেও বর্তমানে ২৫০/৩০০ জন সদস্য রয়েছে বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়। উক্ত প্রতিষ্ঠানের কোনো রক্ষিত জামানত নেই বলে তথ্য পাওয়া যায়।


অভিযান কালে কথিত ও ভুয়া “শিবপুর ক্ষুদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড” অফিস হতে প্রতারণায় ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী যেমনঃ ভর্তি ফরম, ঋণ প্রহীতার ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের জীবন বৃত্তান্ত, লিফলেট, সিল, বিভিন্ন নামে সঞ্চয় পাশবই, অব্যবহৃত পাশ বই, দৈনিক কিন্তি ও ঋণ বিতরণের বিভিন্ন রেজিষ্টার, ব্যাংকচেকসহ ব্যাংক ষ্ট্যাম্প, আইডি কার্ড, দৈনিক কিন্তি আদায়ের শিট, মাইসার ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশন এর ঋণের আবেদনপত্র, মাইসার ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশন এর সঞ্চয় ও ঋণ পাশ বই, মাইসার ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশন হিসাব খোলার আবেদন, মাইসার ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশন এর অব্যবহৃত ডেবিট ভাউচার বই, মাইসার ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশন সঞ্চয় আদায় শীট, সভাপতি মোঃ ফয়েজউল্লাহ এর নামে কমিউনিটি ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি এর বিভিন্ন প্রকার সার্টিফিকেট, চেক বই, মনিটর, সিপিইউ উদ্ধার করা হয়। 


গ্রেফতারকৃত অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলোঃ


ক। মোঃ ফয়েজ উল্লাহ (৫০), জেলা- ভোলা।

খ। আফরিন আক্তার (২৪), জেলা- মুন্সীগঞ্জ।

গ। মোছাঃ তাসলিমা বেগম (৩৩), জেলা- ব্রাহ্মণবাড়িয়া।


প্রতারক সংগঠনের কার্যপদ্ধতি/প্রতারণার কৌশলঃ


(ক)  সদস্য সংগ্রহঃ এই প্রতারক চক্রের মাঠ পর্যায়ের কর্মী/সদস্যদের মাধ্যমে রাজধানীর মিরপুরস্থ বিভিন্ন বস্তি এলাকার প্রতিবন্ধী, ভিক্ষুক, সেলুনের কর্মচারী, মনোহারী ও ফুটপাতের দোকানদার, গৃহকর্মী ও নিম্নআয়ের মানুষদের টার্গেট করে ঋণের লোভ দেখিয়ে সঞ্চয়ের নামে তাদের কোম্পানী’তে বিনিয়োগ/ডিপিএস করতে উদ্বুদ্ধ করে।


(খ) ভিকটিমদের প্রলুব্ধকরণ ও সঞ্চয় সংগ্রহঃ এরা ভুক্তভোগীদেরলে প্রলুব্ধ ও বিভিন্ন তথ্যাদি সংগ্রহ করে নানান কৌশলে ভুলিয়ে প্রতারক চক্রের অফিস কার্যালয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে। “শিবপুর ক্ষদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড” প্রতিদিন আনুমানিক ২৫০ জন গ্রাহকের কাছ থেকে সঞ্চয় সংগ্রহ করে।


(গ)  বিভিন্ন ভুয়া প্রকল্প প্রচারঃ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকল্প প্রচার করে যেমন-১। মুদারাবা ডিপোজিট স্কিম, ২। মুদারাবা কোটিপতি বিশেষ সঞ্চয়, ৩। মুদারাবা লাখপতি ডিপোজিট স্কিম, ৪। মুদারাবা মিলিওনিয়ার ডিপোজিট স্কিম, ৫। মুদারাবা পেনশন ডিপোজিট ইত্যাদির প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষ, প্রতিবন্ধী, ভিক্ষুকদের কাছ থেকে প্রতারনামূলকভাবে নগদ অর্থ হাতিয়ে নিয়ে আসছিলো।


(ঘ) স্বল্প সময়ে ঋণ প্রদানের প্রলোভনঃ গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা ভুক্তভোগীদের বিভিন্নভাবে অল্প সময়ে ঋণ প্রদানের নিশ্চয়তা প্রদান করে “শিবপুর ক্ষুদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড” এ সঞ্চয়/বিনিয়োগ/ডিপিএস করতে আগ্রহী করে আসছিলো। ভুক্তভোগীদের বলা হতো ১০-১৫ দিন ঠিকমত নির্দিষ্ট হারে সঞ্চয় প্রদান করলে তাদেরকে ঋণ প্রদান করা হবে যাতে করে তারা সুন্দরভাবে ব্যবসা করতে পারে। কিন্তু ভূক্তভোগীদের দু'একজনকে ঋণ দিলেও কেউ সঞ্চয় থেকে ঋণ পেতো না।


(ঙ) ভূক্তভোগীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহঃ এ কোম্পানীর কিছু সদস্য দৈনিক ভিত্তিতে ভূক্তভোগীদের কাছ থেকে সঞ্চয়/ডিপিএস এর টাকা সংগ্রহ করতো। ভুক্তভোগীদেরকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখানো হতো তারা যদি সময়মত সঞ্চয়/ডিপিএস এর টাকা না পরিশোধ করে তাহলে তাদেরকে সঠিক সময়ে ঋণ প্রদান করা হবেনা বা মেয়াদ শেষে তারা মুনাফা কম পাবে এবং জরিমানাও করা হবে।


(চ) ফ্ল্যাট/জমি দেয়ার আশ্বাসঃ প্রতারণার আর একটি কৌশল হিসেবে ভূক্তভোগীদেরকে বুঝানো হতো যে দৈনিক মাত্র ২০০/৩০০ টাকা করে জমা করলে একসময় ঢাকা শহরে তাদের একটি করে ফ্ল্যাট বা জমি দেওয়া হবে।


(ছ) প্রতারক চক্রটি “শিবপুর ক্ষুদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড” এবং ভুয়া ও অনুমোদনবিহীন “মাইসার ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশন”কে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান বলে মিথ্যা আশ্বাস প্রদান করতো।


প্রতারক ফয়েজ সম্পর্কে অন্যান্য তথ্যাদিঃ মূল অভিযুক্ত উক্ত কমিটির সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ’র নিজ জেলা ভোলা। সে ভোলার স্থানীয় একটি স্কুল হতে এসএসসি পাশ করেছে। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে জীবিকার তাগিদে ভোলা হতে ঢাকায় এসে মিরপুরের ১৪ নম্বরে থেকে কনস্ট্রাকশনের কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে ২০০৫ সাল হতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সে কাফরুলের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ফিল্ড অফিসার পদে চাকুরী করেছেন। গত ২০২১ সালে নিজে “শিবপুর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতি লিমিটেড” প্রতিষ্ঠা করে এবং পরবর্তীতে সে এই সমিতির নাম বেআইনিভাবে বিকৃত ও পরিবর্তন করে প্রতারনার উদ্দেশ্যে “শিবপুর ক্ষুদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড” নামে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই কোম্পানীর মোট সদস্য সংখ্যা ২৫০-৩০০ জন এবং প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিগত ৫ মাসে আনুমানিক ৫০ লক্ষাধিক অর্থ আত্মসাৎ করেছে বলে অনুসন্ধানে জানা যায়। ব্যাক্তিগত জীবনে ফয়েজ বিবাহিত, তার এক স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে।


সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটিঃ উক্ত সমিতির সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ নিজে, সহ-সভাপতি তার বন্ধু পলাতক আসামী সিরাজুল ইসলাম, সম্পাদক তার স্ত্রী পলাতক আসামী রোকেয়া বেগম, যুগ্ন সম্পাদক শ্যালক পলাতক আসামী আলাউদ্দিন, কোষাধ্যক্ষ ছেলে পলাতক আসামী আরিফ হোসেন এবং সদস্য মোঃ জামিল হোসেন ওয়াদুদ তার বন্ধু। উক্ত সমিতির কার্যকরি সমিতি সকল সদস্য তার স্ত্রী, সন্তান ও বন্ধুরা।  


মূল অভিযোগ সমূহঃ

 প্রতারক ফয়েজ উল্লাহ “শিবপুর ক্ষদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড” নামে নিবন্ধন নিলেও প্রতারণার লক্ষ্যে “শিবপুর ক্ষদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড” নামে অবৈধভাবে ঋণদানের কার্যক্রম চালু ও লিফলেট প্রচার করে আসছিলো।

 প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকিং কার্যক্রম বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদিত নয় যা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং এনজিও হিসেবে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি আর্থিক লেনদেনের জন্য অনুমোদিত নয়। 

 ‘‘মাইসার ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশন’’ (MWF) এর কোনো অনুমোদন নেই। 

 ‘‘কমিউনিটি ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’’ নামক প্রতিষ্ঠানের কোনো অনুমোদন নেই।

 প্রতিষ্ঠানের নামে কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। 


সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব-৪ উক্ত অভিযানটি পরিচালনা করে। গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন। অদূর ভবিষ্যতে এইরুপ অসাধু সংঘবব্ধ প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে র‌্যাব-৪ এর জোড়ালো সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত থাকবে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আশুলিয়ার চেতনা মাল্টিপারপাসের ১০ ভয়ংকর প্রতারককে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব-৪

কক্সবাজারের ঝিলংজা থেকে দশহাজার পিস ইয়াবা সহ মাদক কারবারি কে আটক করেছে র‍্যাব-১৫

কেরানীগঞ্জ থেকে পুলিশের এএসপি পরিচয়দানকারি প্রতারককে আটক করেছে র‍্যাব-১০