দিনশেষে সব পাখি ঘরে ফিরে কিন্তু সব জেলেরা ঘরে ফিরে না
তুফান সাকিবঃ-
জেলেদের জীবনটা পৃথিবীর সংগ্রামী জীবন
গুলোর মধ্যে একটি। জেলেদের কষ্টময় জীবনী সম্পর্কে মূল আলোচনা একটু পরে করছি। তার আগে আনুষাঙ্গিক কিছু কথা না বললেই নয়। বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। শুধু নদীমাতৃক নয় বলা যায় নদীই এদেশের প্রাণ।এদেশে বেশ কয়েকটি বড় বড় নদী আছে। নদীগুলো হচ্ছেঃপদ্মা,মেঘনা,বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী,যমুনা ইত্যাদি। এছাড়াও সারাদেশে এগুলোর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা বহমান আছে। তাছাড়াও কিছু ছোট নদীও আছে। নদীগুলোর বুকে জোয়ার-ভাঁটার খেলা। অপরুপ বৈচিত্র্যময়। একেকটি বড় নদীগুলোর তীরে দাঁড়িয়ে চোখ দুটি মেলে দিলে ধরা পড়ে কতগুলো মোহনীয় দৃশ্য। সত্যিই স্রষ্টার অপার মহিমায় মহিমান্বিত। নদীর ধারের সাদা সাদা কাশবন,নদীর দুই ধারের সবুজ ক্ষেত,সকাল বেলায় নদীর পানিতে বুনোহাঁসের খেলা, সাদা বকের পাল,মাছরাঙা পাখির শিকার ধরার উদ্দেশ্যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা, নদীর স্রোতধারা,নদীর পাড়ের জনজীবন সবমিলিয়ে অপূর্ব। এছাড়াও নদীর অনেকগুলো গুণাগুণ রয়েছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্যগত দিক থেকেও নদীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে, এই নদী তার পাড়ের জনজীবনের জন্য মাঝে মাঝে কাল হয়েও দাড়ায়।
কারণ, খরস্রোতা নদী যেন আর বাধা মানে না।তার স্রোতের প্রখর ধারা অনেক সময় পাড়ের ছোট ছোট বস্তি বা গ্রামগুলিকে ভেঙে চূর্ন-বিচূর্ণ করে দেয়। এজন্যই তো কাব্যকথায় প্রচলিত যে,'নদীর এ পার ভাঙে ও পার গড়ে এই তো নদীর খেলা। 'যাইহোক, নদী যখন খরস্রোতা হয়ে ওঠে তখন অগণিত মানুষ গৃহহারা হয়ে পড়ে। হাজারো মানুষ বাস্তুহারা হয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। অনেক কষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করে তাঁরা। তারপরও অব্যাহত বেচে থাকার প্রচেষ্টা।
প্রকৃগত দিক থেকে এটাই স্বাভাবিক এবং বাস্তবতা। প্রত্যেক জিনিসেরই ভালো এবং মন্দ দুই দিকেই বিদ্যমান।
মূল আলোচনাঃ
জেলে নামটি পেশাগত একটি ভূষণ। জেলে বলতে বোঝায়,যাঁরা মাছ শিকার করে জীবীকা নির্বাহ করে থাকে। আসলে জেলে জীবন প্রকৃত অর্থে একটি সংগ্রামী জীবন। কারণ, হাজারো প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে জীবন পাড়ি দিতে হয় জেলেদেরকে।
সাধারণত নদীর পাড়ে বসবাস করে থাকে জেলেরা। নদী অঞ্চলগুলোতে গেলেই তার প্রমান মিলে। সেখানে গেলে দেখা যায়, নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট জেলে পল্লী। জেলেদের জীবন যখন নদীনির্ভর তাই নদীর পাড়েই এসব পল্লী গড়ে ওঠে। নদীতে বর্ষাকাল এলে বন্যা ওঠে সেজন্য সামান্য কিছু খড় অথবা টিনের ছাউনি এবং কিছু বাঁশের খুঁটি দিয়ে নির্মিত তাদের ঘরবাড়ি। বাড়িঘরের ভিতরে ধনীদের মতো হয়তো কোনো বিলাসবহুল আসবাবপত্র নেই। তার বদলে হয়তো একগুচ্ছ জাল রাখা আছে। আছে জীবন নির্বাহের জন্য সামান্য কিছু জিনিসপত্র। তবুও তাদের কিন্তু পারিবারিক চাহিদাগুলো মেটাবার জন্যই সেখানে তারা বসবাস করে।সবসময় নদীত মাছবহুল থাকে না। বছরের কোনো কোনো সময় মাছবিহীন অথবা সংকটয় অবস্থার সৃষ্টি হয়।সেই সময়গুলোতে যখন মাছ ধরার মাধ্যমে দিন চলার মতোও সাধ্য জুটে না তখন তাঁরা অনেক সময় নৌকার মাধ্যমে মানুষজন পারাপার করে জীবন চালায়।সেই নৌকা তৈরি করাও নির্ভর করে নিকটবর্তী নদীর আকার-আকৃতি, নদীর পানিপ্রবাহ,গাছের প্রাপ্যতাসহ ইত্যাদি নানা বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে। তাছাড়াও সেসময় তাঁরা পূর্বের সংরক্ষিত মাছ শুকিয়ে তৈরিকৃত শুটকি বিক্রিও করে থাকে। আবার জেলেরা কিন্তু যেসময় নদীতে মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় সেই সময়গুলো তাদের অনেকটা ভালোভাবে পার হয়।তবে পুরোপুরি নয়।তখন জেলেরা একটা নৌকায় করে সাথে কতগুলো জাল নিয়ে শুরু করে জীবনের পথচলা। মাছ ধরার উদ্দেশ্যে দীর্ঘপথে ধাবমান হয়।বলা যায়, তাঁরা পরবাসী জীবন যাপন করে সেসময়টাতে।নদী থেকে নদী এমনকি সমুদ্র পর্যন্ত তাঁরা পাড়ি দেয়। এসময়টায় তাঁদের বাড়িতে ফেরা অনেকটাই অনিশ্চিত। কারণ, মাছ তো ধরতেই হবে। নাহলে জীবন চলবে কিভাবে? জেলেবাড়ির গৃহীণীও যেন বেদনাবিধুর সময় পার করে তখন। কারণ, পুরুষের ভালোবাসা ও সহযোগিতা ছাড়া একটি গৃহ বা সংসার পরিচালনা করা একজন নারীর পক্ষে সত্যিই অনেকটা কষ্টের ব্যাপার। এভাবে অগোছালোভাবেই তাঁদেরকে জীবনযাপন করতে হয়।জীবনের তাড়না কেবল তাঁদেরকে দেখলেই বোঝা যায়। এদিকে, যেসব জেলেরা ঘরে ফিরে আসার চিন্তা না করে জীবনের তাগিদে শতকষ্টের পর মাছ বাজারজাত করার চিন্তা করে তখন তো আড়তদারদের ভেজাল আছেই।কেননা,আড়তদাররা তখন মাছের সঠিক মূল্য দিতে চায় না। এটা জেলেদের পক্ষে একটা কঠোর জুলুমের স্টিমরোলার। অতএব, বোঝাই যাচ্ছে যে, কতটা মানবেতর জীবনযাপন করতে হয় জেলেদের। না পারছে দিনশেষে ঘরে ফিরতে,না পাচ্ছে পরিশ্রমের সঠিক মূল্য।যেহেতু জেলেরা আমাদের জাতিগত পরিচয় বা ঐতিহ্য বহন করে তাই জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি আমাদের সকলেরই কিছু দায়িত্ব পালন করা দরকার। জেলেদের জীবনীর কষ্টগুলোকে উপলব্ধি করার জন্যই উপরে বলা হয়েছে যে,দিনশেষে সব পাখি ঘরে ফিরলেও সব জেলেদের ঘরে ফিরা আর হয়ে ওঠে না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন